অঙ্গীকারনামা চুক্তি পত্রের নমুনা: সম্পূর্ণ গাইড!

প্রিয় পাঠক, কেমন আছেন সবাই? আশা করি ভালো আছেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান ধরনের চুক্তি বা বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয়, তাই না? ধরুন, আপনি কাউকে টাকা ধার দিচ্ছেন কিংবা কোনো কাজের জন্য কারো সাথে বোঝাপড়া করছেন। মৌখিক কথার কিন্তু তেমন কোনো ভিত্তি নেই, তাই ঝামেলা এড়াতে লিখিত আকারে একটি 'অঙ্গীকারনামা' বা 'চুক্তিপত্র' থাকাটা খুব জরুরি। এই অঙ্গীকারনামা আসলে কী, এর গুরুত্ব কী, আর কীভাবে একটি সঠিক অঙ্গীকারনামা তৈরি করবেন, তা নিয়েই আজ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন, জেনে নিই, কীভাবে একটি ঝামেলামুক্ত অঙ্গীকারনামা তৈরি করা যায়!

অঙ্গীকারনামা চুক্তিপত্র কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অঙ্গীকারনামা হলো একটি লিখিত দলিল, যেখানে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, শর্ত বা প্রতিশ্রুতির উল্লেখ থাকে। এটি একটি চুক্তি যা উভয় পক্ষকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বাংলাদেশে, এই ধরনের দলিল আইনি ভিত্তি প্রদান করে এবং ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা বিরোধ দেখা দিলে তা সমাধানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

অঙ্গীকারনামার গুরুত্ব

আপনি হয়তো ভাবছেন, "মুখে বললেই তো হয়, এত লেখার কী দরকার?" কিন্তু বিশ্বাস করুন, লেখার গুরুত্ব অপরিসীম।

  • আইনি সুরক্ষা: অঙ্গীকারনামা আপনাকে আইনি সুরক্ষা দেয়। যদি কেউ তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তাহলে আপনি এই দলিল ব্যবহার করে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
  • স্বচ্ছতা: এটি চুক্তির শর্তাবলীকে স্পষ্ট করে তোলে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
  • বিশ্বাসযোগ্যতা: লিখিত চুক্তি পক্ষগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
  • প্রমাণ: এটি একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে কাজ করে, যা আদালতে উপস্থাপন করা যায়।

ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুকে কিছু টাকা ধার দিলেন। মুখে মুখে দিলেন, কিন্তু পরে যখন ফেরত চাইলেন, বন্ধু অস্বীকার করল। তখন কী করবেন? যদি একটি অঙ্গীকারনামা থাকত, তাহলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না, তাই না?

একটি কার্যকর অঙ্গীকারনামা কেমন হওয়া উচিত?

একটি কার্যকরী অঙ্গীকারনামা তৈরি করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। এটি শুধু সাদা কাগজে কিছু লেখা নয়, বরং এর একটি নির্দিষ্ট কাঠামো ও কিছু অপরিহার্য উপাদান থাকে।

অপরিহার্য উপাদানসমূহ

একটি আদর্শ অঙ্গীকারনামায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে:

  • পক্ষগণের পরিচয়: চুক্তিতে আবদ্ধ প্রতিটি পক্ষের সম্পূর্ণ নাম, ঠিকানা, পেশা, এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (NID) উল্লেখ করা আবশ্যক।
  • চুক্তির বিষয়বস্তু: কী বিষয়ে চুক্তি হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। যেমন, টাকা ধার দেওয়া, জমি বিক্রি, বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা।
  • শর্তাবলী: চুক্তির বিস্তারিত শর্তাবলী, যেমন- কত টাকা ধার দেওয়া হচ্ছে, কখন ফেরত দিতে হবে, সুদের হার (যদি থাকে), বা কাজের সময়সীমা ইত্যাদি উল্লেখ করা।
  • সময়সীমা: চুক্তিটি কতদিনের জন্য কার্যকর থাকবে এবং কখন এর মেয়াদ শেষ হবে, তা উল্লেখ করা।
  • ক্ষতিপূরণ (যদি থাকে): যদি কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে কী ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তা উল্লেখ করা।
  • সাক্ষী: কমপক্ষে দুইজন নিরপেক্ষ সাক্ষীর স্বাক্ষর ও পরিচয়। সাক্ষীরা চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত থাকবেন।
  • তারিখ ও স্থান: চুক্তিটি কোন তারিখে এবং কোন স্থানে সম্পাদিত হচ্ছে, তা উল্লেখ করা।
  • স্বাক্ষর: চুক্তি সম্পাদনকারী প্রতিটি পক্ষের স্বাক্ষর।

অঙ্গীকারনামার ভাষা ও কাঠামো

অঙ্গীকারনামার ভাষা সহজ, সরল এবং স্পষ্ট হওয়া উচিত। কোনো জটিল শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা উচিত নয়, যা পক্ষগণের বুঝতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত নিম্নলিখিত কাঠামো অনুসরণ করে:

  • শিরোনাম: অঙ্গীকারনামা/চুক্তিপত্র
  • ভূমিকা: পক্ষগণের পরিচয় এবং চুক্তির উদ্দেশ্য।
  • মূল বিষয়বস্তু: চুক্তির বিস্তারিত শর্তাবলী।
  • শর্তভঙ্গের ফলাফল: যদি কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করে।
  • সাক্ষর ও তারিখ: পক্ষগণ এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর ও তারিখ।

অঙ্গীকারনামা চুক্তি পত্রের নমুনা

Google Image

এবার আমরা একটি সাধারণ অঙ্গীকারনামা চুক্তি পত্রের নমুনা দেখব, যা আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে পারেন।


অঙ্গীকারনামা/চুক্তিপত্র

তারিখ: [দিন] [মাস], [বছর]

স্থান: [আপনার ঠিকানা]

প্রথম পক্ষ (অঙ্গীকারকারী):

  • নাম: [আপনার সম্পূর্ণ নাম]
  • পিতা/স্বামী: [পিতা/স্বামীর নাম]
  • ঠিকানা: [বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম, ডাকঘর, উপজেলা, জেলা]
  • জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: [আপনার NID নম্বর]
  • পেশা: [আপনার পেশা]

দ্বিতীয় পক্ষ (অঙ্গীকারগ্রহীতা):

  • নাম: [যার সাথে চুক্তি করছেন তার সম্পূর্ণ নাম]
  • পিতা/স্বামী: [পিতা/স্বামীর নাম]
  • ঠিকানা: [বর্তমান ঠিকানা, গ্রাম, ডাকঘর, উপজেলা, জেলা]
  • জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: [তার NID নম্বর]
  • পেশা: [তার পেশা]

ভূমিকা:
আমরা, উপরোক্ত প্রথম পক্ষ ও দ্বিতীয় পক্ষ, নিম্নলিখিত শর্তাবলীতে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করছি।

Google Image

১. চুক্তির বিষয়বস্তু:
প্রথম পক্ষ, দ্বিতীয় পক্ষ থেকে [টাকার পরিমাণ, যেমন: পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র] ([৫০,০০০/-] টাকা) [ধার/অগ্রিম/অন্যান্য কারণ উল্লেখ করুন] বাবদ গ্রহণ করছি/করছেন। এই অর্থ [নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে, যেমন: ব্যবসা সম্প্রসারণ/চিকিৎসা খরচ] ব্যবহার করা হবে।

২. পরিশোধের শর্তাবলী:
প্রথম পক্ষ অঙ্গীকার করছে যে, উল্লিখিত অর্থ [নির্দিষ্ট তারিখ, যেমন: ৩০/১২/২০২৪ তারিখের মধ্যে] অথবা [নির্দিষ্ট কিস্তিতে, যেমন: প্রতি মাসের ৫ তারিখে ৫,০০০/- টাকা করে দশটি কিস্তিতে] দ্বিতীয় পক্ষকে ফেরত দেবে।

৩. সুদের হার (যদি প্রযোজ্য হয়):
যদি উভয় পক্ষ সম্মত হয়, তাহলে [নির্দিষ্ট সুদের হার, যেমন: মাসিক ২% হারে] সুদ প্রযোজ্য হবে। (যদি সুদ না থাকে, এই অংশটি বাদ দিন)

৪. শর্তভঙ্গের ফলাফল:
যদি প্রথম পক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উল্লিখিত অর্থ বা কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে দ্বিতীয় পক্ষ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে এবং প্রথম পক্ষ তার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকবে।

৫. অন্যান্য শর্তাবলী (যদি থাকে):

  • [এখানে অন্য কোনো নির্দিষ্ট শর্ত থাকলে উল্লেখ করুন, যেমন: কোনো সম্পদ বন্ধক রাখা হলো কিনা বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ করা হবে কিনা।]

৬. সাক্ষ্য ও স্বাক্ষর:
আমরা, উভয় পক্ষ, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে এই অঙ্গীকারনামা পাঠ করে এর প্রতিটি শর্ত মেনে নিয়ে নিচে স্বাক্ষর করলাম।

প্রথম পক্ষের স্বাক্ষর:
[স্বাক্ষর]
[প্রথম পক্ষের নাম]

দ্বিতীয় পক্ষের স্বাক্ষর:
[স্বাক্ষর]
[দ্বিতীয় পক্ষের নাম]

Google Image

সাক্ষীগণ:
আমরা, নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ, এই অঙ্গীকারনামার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত আছি এবং উভয় পক্ষের স্বাক্ষর আমাদের সামনেই সম্পাদিত হয়েছে।

সাক্ষী ১:

  • নাম: [সাক্ষী ১ এর নাম]
  • পিতা/স্বামী: [পিতা/স্বামীর নাম]
  • ঠিকানা: [ঠিকানা]
  • জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: [NID নম্বর]
  • স্বাক্ষর:

সাক্ষী ২:

  • নাম: [সাক্ষী ২ এর নাম]
  • পিতা/স্বামী: [পিতা/স্বামীর নাম]
  • ঠিকানা: [ঠিকানা]
  • জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: [NID নম্বর]
  • স্বাক্ষর:

কিছু জরুরি পরামর্শ

  • নোটারি করা: সম্ভব হলে, অঙ্গীকারনামাটি একজন নোটারি পাবলিক দ্বারা সত্যায়িত করিয়ে নিন। এতে এর আইনি বৈধতা আরও দৃঢ় হবে।
  • স্ট্যাম্প পেপার: চুক্তিটি অবশ্যই নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপারে লেখা উচিত। স্ট্যাম্প পেপারের মূল্যমান চুক্তির ধরনের ওপর নির্ভর করে।
  • স্পষ্টতা: কোনো অস্পষ্টতা বা ambiguitty রাখবেন না। প্রতিটি শর্ত যেন পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
  • আইনজীবীর পরামর্শ: গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল চুক্তির ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

h3: অঙ্গীকারনামা কি আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য?

হ্যাঁ, অবশ্যই। একটি যথাযথভাবে সম্পাদিত, স্বাক্ষরিত এবং প্রয়োজনে নোটারি করা অঙ্গীকারনামা আদালতে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

h3: অঙ্গীকারনামা তৈরিতে কত খরচ হতে পারে?

খরচ মূলত স্ট্যাম্প পেপারের মূল্য, নোটারি ফি (যদি নোটারি করেন) এবং আইনজীবীর ফি (যদি আইনজীবী নিয়োগ করেন) এর উপর নির্ভর করে। এটি চুক্তির মূল্যমান এবং জটিলতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।

h3: অনলাইন থেকে প্রাপ্ত নমুনা ব্যবহার করা কি নিরাপদ?

আপনি অনলাইন থেকে নমুনা ব্যবহার করতে পারেন, তবে অবশ্যই আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী সেটি ভালোভাবে যাচাই করে এবং পরিবর্তন করে নিতে হবে। প্রয়োজনে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।

h3: একটি অঙ্গীকারনামা কতদিন পর্যন্ত বৈধ থাকে?

একটি অঙ্গীকারনামার বৈধতা নির্ভর করে এর শর্তাবলী এবং দেশের প্রচলিত আইনের ওপর। সাধারণত, চুক্তির শর্তাবলী অনুযায়ী এর মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি বৈধ থাকে। তবে, এটি দেওয়ানি কার্যবিধির তামাদি আইনের আওতায় আসে।

শেষ কথা

আশা করি, অঙ্গীকারনামা চুক্তি পত্রের নমুনা এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে আপনাদের একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছি। মনে রাখবেন, যেকোনো আর্থিক লেনদেন বা গুরুত্বপূর্ণ বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে লিখিত দলিল থাকাটা আপনার সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু আপনাকে নয়, বরং আপনার সাথে চুক্তিবদ্ধ অন্য পক্ষকেও একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে রাখে।

যদি আপনার জীবনে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে একটি অঙ্গীকারনামার প্রয়োজন, তবে আর দেরি না করে আজই একটি তৈরি করে ফেলুন। এতে ভবিষ্যতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা থেকে সহজেই মুক্তি পেতে পারবেন। আপনার যদি আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনার মতামত আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *