যৌতুক প্রথার কুফল: সমাজকে ধ্বংসের মুখে!

যৌতুক প্রথা, এই শব্দটি শুনলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়, তাই না? আমাদের সমাজে এর প্রভাব এতটাই গভীর যে, আমরা চাইলেও একে এড়িয়ে যেতে পারি না। যৌতুক প্রথা শুধু একটি সামাজিক ব্যাধি নয়, এটি আমাদের পারিবারিক শান্তি, নারীর মর্যাদা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আসুন, আজ আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে একটু খোলাখুলি আলোচনা করি। এই প্রথা আমাদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, তা নিয়ে কিছু নতুন কথা জানবো।

Table of contents

যৌতুক প্রথা কী এবং কেন এটি আজও টিকে আছে?

যৌতুক প্রথা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, বিয়ের সময় কনে পক্ষ থেকে বর পক্ষকে দেওয়া অর্থ, অলংকার বা অন্য কোনো মূল্যবান সামগ্রী। এটি এক ধরনের লেনদেন, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও আমাদের সমাজে আজও এর প্রচলন ব্যাপক। কিন্তু কেন?

এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। যেমন:

  • সামাজিক চাপ: অনেক সময় পরিবার বা সমাজের চাপেই মানুষ যৌতুক দিতে বা নিতে বাধ্য হয়। "অমুকের মেয়েকে তো এত দিয়েছে, আমাদের মেয়েকে কেন কম দেবো?"—এই ধরনের তুলনামূলক মনোভাব কাজ করে।
  • আর্থিক লোভ: কিছু পরিবার যৌতুককে আর্থিক লাভের উৎস হিসেবে দেখে। তারা মনে করে, এর মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব।
  • শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কার: শিক্ষার অভাব এবং কিছু পুরনো কুসংস্কার এই প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অনেকে মনে করেন, যৌতুক ছাড়া বিয়ে হলে তা শুভ হয় না বা সমাজে সম্মান কমে যায়।
  • নারীর ক্ষমতায়নের অভাব: নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় না, তখন তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাকে অনেক সময় যৌতুকের বলি হতে হয়।

যৌতুকের কুফল: শুধু কি আর্থিক ক্ষতি?

যৌতুক প্রথা যে শুধু আর্থিক ক্ষতি করে, তা কিন্তু নয়। এর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে এর নেতিবাচক ছায়া পড়ে।

পারিবারিক জীবনে যৌতুকের প্রভাব

  • সম্পর্কের অবনতি: যৌতুকের কারণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুরু থেকেই তিক্ত হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, যৌতুক না পেলে বা প্রত্যাশা অনুযায়ী না পেলে কনেকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
  • পারিবারিক কলহ: যৌতুক নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে প্রায়শই ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে। এটি এক ধরনের অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে, যা পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল করে দেয়।
  • আত্মহত্যার প্রবণতা: যৌতুকের চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এটি সত্যিই অত্যন্ত মর্মান্তিক।

নারীর ওপর যৌতুকের প্রভাব

যৌতুক প্রথা নারীর জীবনকে নানাভাবে দুর্বিষহ করে তোলে। নিচে একটি সারণির মাধ্যমে এর কিছু প্রধান প্রভাব তুলে ধরা হলো:

প্রভাবের ক্ষেত্র বিস্তারিত বিবরণ
মানসিক নির্যাতন যৌতুকের জন্য কনেকে প্রতিনিয়ত কটূ কথা শুনতে হয়, অপমান করা হয়। তাকে "যৌতুক আনতে পারিসনি" এমন কথা বলে খোটা দেওয়া হয়।
শারীরিক নির্যাতন যৌতুক না পেলে অনেক সময় কনেকে মারধর করা হয়, যা গুরুতর শারীরিক আঘাতের কারণ হতে পারে।
শিক্ষাবঞ্চিত হওয়া মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুক জোগাড় করতে গিয়ে অনেক পরিবার তাদের মেয়েকে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। তারা মনে করে, যত দ্রুত বিয়ে দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।
স্বাধীনতাহীনতা যৌতুকের কারণে নারী তার নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারায়। সে যেন একটি পণ্যে পরিণত হয়।
আত্মমর্যাদাহীনতা প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য চাপ এবং অপমান নারীর আত্মমর্যাদাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

যৌতুক প্রথা সমাজের অগ্রগতিকেও থামিয়ে দেয়।

  • সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি: যৌতুক সমাজের ধনী-গরীবের বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। গরীব পরিবারগুলো তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে।
  • নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা: অনেক পরিবার যৌতুকের ভয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে স্বাবলম্বী না করে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। এতে নারী শিক্ষার হার কমে যায়।
  • অর্থনৈতিক অস্থিরতা: যৌতুক জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারগুলো নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলে বা ঋণ নেয়, যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

যৌতুক প্রথা প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

যৌতুক একটি সামাজিক সমস্যা। তাই এর সমাধানও করতে হবে সামাজিকভাবে। আসুন, আমরা কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করি:

Google Image

১. সচেতনতা বৃদ্ধি

যৌতুকের কুফল সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

গণমাধ্যমের ভূমিকা

টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যৌতুকের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। নাটক, সিনেমা, প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে এর ভয়াবহতা তুলে ধরা উচিত। যেমন, সম্প্রতি আমাদের দেশের কিছু নাটকে যৌতুকবিরোধী বার্তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌতুকবিরোধী আলোচনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা গেলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম এই প্রথা থেকে মুক্ত হতে পারবে।

২. আইন প্রয়োগ ও শক্তিশালীকরণ

বাংলাদেশে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া উভয়ই দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

আইনের কঠোর প্রয়োগ

Google Image

যৌতুক সংক্রান্ত অভিযোগগুলো দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। এতে সমাজে একটি বার্তা যাবে যে, যৌতুক একটি গুরুতর অপরাধ।

আইনি সহায়তা সহজলভ্য করা

যৌতুকের শিকার নারীরা যাতে সহজেই আইনি সহায়তা পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করা উচিত।

৩. নারীর ক্ষমতায়ন

নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তখন তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে।

নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থান

নারীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। একজন শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারী সহজেই যৌতুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

আত্মরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসের প্রশিক্ষণ

নারীদের আত্মরক্ষা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এতে তারা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।

Google Image

৪. সামাজিক আন্দোলন ও পারিবারিক দায়িত্ব

যৌতুক প্রথা দূর করতে সমাজের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব রয়েছে।

সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা

পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে যৌতুকবিরোধী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটিগুলো যৌতুক সংক্রান্ত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে।

পরিবারের ভূমিকা

পরিবারের উচিত তাদের সন্তানদের যৌতুকের কুফল সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দেওয়া। বিয়ের ক্ষেত্রে যৌতুক না নেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া উচিত।

ছেলে ও মেয়ের উভয়েরই দায়িত্ব

শুধু মেয়ে পক্ষ নয়, ছেলে পক্ষেরও উচিত যৌতুক চাওয়ার মতো জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকা। একজন আদর্শ ছেলে কখনোই যৌতুক চাইতে পারে না। একইভাবে, মেয়েরাও যাতে যৌতুকের বলি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। আমরা যদি সবাই মিলে এই শপথ নিই, তাহলে পরিবর্তন আসবেই।

যৌতুক নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা

আমাদের সমাজে যৌতুক নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা এই প্রথাকে আরও শক্তিশালী করে।

  • "যৌতুক না নিলে মেয়েকে সম্মান করা হয় না": এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। সম্মান আসে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে, কোনো লেনদেন থেকে নয়।
  • "যৌতুক দিলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয়": যৌতুক দিয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয় না, বরং তার জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য অর্থ নয়, প্রয়োজন বোঝাপড়া।
  • "যৌতুক না নিলে ভালো পাত্র পাওয়া যায় না": এটিও একটি মিথ্যা ধারণা। একজন ভালো পাত্র কখনোই যৌতুক চাইবে না। বরং, যৌতুক চাওয়াটাই তার চারিত্রিক দুর্বলতা প্রমাণ করে।

এসব ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।

আপনার ভূমিকা: একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনি কী করতে পারেন?

আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি একা কী করতে পারি? কিন্তু আপনার ছোট একটি পদক্ষেপও সমাজে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

  • নিজের পরিবার থেকে শুরু করুন: যদি আপনার পরিবারে বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ যৌতুক নিতে বা দিতে চায়, তাহলে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি করুন: আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করুন।
  • যৌতুকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিন: যদি আপনার এলাকায় যৌতুকবিরোধী কোনো কার্যক্রম হয়, তাতে অংশ নিন।
  • যৌতুক না নেওয়ার শপথ নিন: আপনি নিজে বা আপনার সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রে যৌতুক না নেওয়া বা না দেওয়ার দৃঢ় শপথ নিন।

মনে রাখবেন, প্রতিটি ছোট পরিবর্তনই সমষ্টিগতভাবে একটি বড় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের এই প্রিয় দেশ থেকে যৌতুকের মতো অভিশাপ দূর করতে হলে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। আপনি কি প্রস্তুত এই পরিবর্তনের অংশ হতে? আপনার মতামত আমাদের জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *