আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রিয়েলিজম – Realism in International Relations

আসুন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটু অন্যভাবে দেখি!

আচ্ছা, কখনো কি মনে হয়েছে, কেন কিছু দেশ সবসময় ক্ষমতা আর নিজেদের স্বার্থের পেছনে ছোটে? কেন তারা অন্য দেশের কথা কম শোনে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটা মজার তত্ত্বে—রিয়ালিজম বা বাস্তববাদ। ভয় পাবেন না, কঠিন কিছু নয়! বরং এটা যেন একটা থ্রিলার গল্পের মতো, যেখানে প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে চাল চালছে।

Table of contents

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রিয়েলিজম: আসল খেলোয়াড় কে?

রিয়ালিজম হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার একটা চশমা। এই চশমা দিয়ে দেখলে আপনি বুঝবেন, দুনিয়ার দেশগুলো আসলে কিছু খেলোয়াড়ের মতো। তারা সবাই চায় নিজেদের শক্তি বাড়াতে, টিকে থাকতে এবং সুযোগ পেলে অন্যকে টেক্কা দিতে। অনেকটা যেন একটা বিশাল দাবা খেলার মাঠ, যেখানে সবাই রাজা হতে চায়!

রিয়ালিজমের মূল কথা

রিয়ালিজম বলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সবসময় ক্ষমতার খেলা। এখানে কোনো দেশই পুরোপুরি ভালো বা খারাপ নয়। সবাই নিজের দেশের নিরাপত্তা আর উন্নতির জন্য কাজ করে। তাই, বন্ধুত্বের চেয়ে স্বার্থটাই আসল।

  • রাষ্ট্রই মূল: রিয়ালিজম অনুযায়ী, একটা দেশের সরকারই সবকিছু। তারা যা করে, সেটাই দেশের হয়ে যায়।
  • নিজেকে বাঁচানো: প্রতিটি দেশ সবার আগে নিজেকে বাঁচাতে চায়। তাই তারা সবসময় শক্তিশালী হতে চায়।
  • ক্ষমতাই শেষ কথা: যার হাতে বেশি ক্ষমতা, সেই বেশি প্রভাবশালী। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার কথাই বেশি শোনা হয়।

রিয়ালিজমের ইতিহাস: সেই গ্রিক যুগ থেকে

রিয়ালিজমের ধারণা কিন্তু নতুন নয়। এর শুরুটা হয়েছিল সেই প্রাচীন গ্রিসে। ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিসের লেখায় এর প্রথম দেখা মেলে। এরপর ইতালির ম্যাকিয়াভেলি, জার্মানির ক্লজভিটস-এর মতো পণ্ডিতেরা এই তত্ত্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারা সবাই বিশ্বাস করতেন, রাজনীতিতে আবেগ বা আদর্শের চেয়ে বাস্তবতাই আসল।

রিয়ালিজমের খুঁটিনাটি: কী কী জানতে হবে?

রিয়ালিজমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এর কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। চলুন, সেগুলো দেখে নেওয়া যাক:

ক্ষমতার রাজনীতি: কার কত জোর?

রিয়ালিজমের মূল কথা হলো ক্ষমতা। একটা দেশের সামরিক শক্তি, অর্থনীতি, কূটনীতি—এগুলোই ঠিক করে দেয়, সে কতটা শক্তিশালী। যে দেশ যত শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক মহলে তার তত বেশি দাম।

সামরিক শক্তি

একটা দেশের কতগুলো সৈন্য আছে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেমন, সেটাই ঠিক করে দেয় দেশটি কতটা শক্তিশালী।

অর্থনৈতিক শক্তি

অর্থনীতি ভালো না থাকলে দেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাই, কোন দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী, সেটাও খুব জরুরি।

কূটনৈতিক শক্তি

কূটনীতি মানে হলো অন্য দেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিজের কাজ হাসিল করা। যে দেশ কুটনীতিতে যত ভালো, সে তত বেশি সুবিধা পায়।

নিরাপত্তা dilemma: বাঁচতে গেলে লড়তে হবে?

নিরাপত্তা dilemma মানে হলো, একটা দেশ যখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য শক্তিশালী হয়, তখন অন্য দেশগুলো ভয় পায়। তারা ভাবে, এই দেশটি হয়তো তাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই তারাও নিজেদের শক্তি বাড়াতে শুরু করে। এতে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়, যা যুদ্ধের কারণও হতে পারে।

ভারসাম্য: কেউ বেশি শক্তিশালী নয়

রিয়ালিজম বলে, কোনো দেশ যদি বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়, তাহলে অন্য দেশগুলো জোট বেঁধে তাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। অনেকটা যেন একটা দাঁড়িপাল্লা, যেখানে সবাই চায় ওজন সমান রাখতে।

রিয়ালিজমের প্রকারভেদ: কত রকমের রিয়েলিজম?

রিয়ালিজম কিন্তু এক রকম নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর নানা রূপ দেখা যায়।

ক্লাসিক্যাল রিয়েলিজম

এই তত্ত্ব বলে, মানুষের স্বভাবের কারণেই যুদ্ধ হয়। মানুষের ভেতরের লোভ, ভয় আর অহংকারই দেশগুলোকে ক্ষমতার পেছনে ছোটায়।

নিওরিয়ালিজম বা স্ট্রাকচারাল রিয়েলিজম

নিওরিয়ালিজম বলে, মানুষের স্বভাব নয়, বরং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কারণেই দেশগুলো এমন আচরণ করে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটাই এমন যে, এখানে সবাই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত।

ডিফেন্সিভ রিয়েলিজম

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দেশগুলো শুধু নিজেদের নিরাপত্তা চায়, অন্যকে আক্রমণ করতে চায় না। তারা শুধু শক্তিশালী হতে চায়, যাতে কেউ তাদের ওপর হামলা করতে না পারে।

অফেন্সিভ রিয়েলিজম

অফেন্সিভ রিয়েলিজম বলে, দেশগুলো সুযোগ পেলেই অন্যকে আক্রমণ করে নিজের ক্ষমতা বাড়াতে চায়। তারা মনে করে, যত বেশি ক্ষমতা, তত বেশি নিরাপত্তা।

রিয়ালিজমের ভালো-খারাপ: সবকিছু কি ঠিক আছে?

রিয়ালিজম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলেও এর কিছু সমালোচনা আছে।

সমালোচনা

  • রিয়ালিজম শুধু ক্ষমতার কথা বলে, সহযোগিতা আর শান্তির কথা বলে না।
  • এটা ধরে নেয়, দেশগুলো সবসময় যুক্তিবাদী আচরণ করে, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় আবেগ আর ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও ঘটনা ঘটে।
  • রিয়ালিজম পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। দুনিয়া তো সবসময় এক রকম থাকে না, তাই না?

রিয়ালিজমের প্রয়োজনীয়তা

এত সমালোচনা সত্ত্বেও রিয়ালিজম কিন্তু এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কেন দেশগুলো এমন আচরণ করে। বিশেষ করে যখন যুদ্ধ বা সংঘাতের মতো ঘটনা ঘটে, তখন রিয়ালিজম আমাদের একটা দিশা দেয়।

কীভাবে রিয়েলিজম বুঝবেন? একটা উদাহরণ

ধরুন, দুটি প্রতিবেশী দেশ আছে—'ক' আর 'খ'। 'ক' দেখল 'খ' তাদের সীমান্তের কাছে অনেক সৈন্য জমা করছে। এখন 'ক'-এর মনে ভয় ঢুকবে, তাই না? তারা ভাববে, 'খ' হয়তো তাদের আক্রমণ করতে পারে।

তখন 'ক' কী করবে?

  1. তারাও তাদের সীমান্তে সৈন্য বাড়াবে।
  2. অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করবে।
  3. আন্তর্জাতিক মহলে 'খ'-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে।

এটাই হলো রিয়ালিজমের মূল কথা। প্রতিটি দেশ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, আর তার জন্য যা করার দরকার, সেটাই করে।

রিয়ালিজম আজকের দুনিয়ায়: কতটা প্রাসঙ্গিক?

আজকের দুনিয়াটা অনেক জটিল। এখানে শুধু ক্ষমতা আর যুদ্ধ নয়, আরও অনেক কিছু আছে—যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক। রিয়ালিজম কি এসব ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য?

রিয়ালিজম যেখানে ফিকে

  • জলবায়ু পরিবর্তন: এটা কোনো একটা দেশের সমস্যা নয়, এটা পুরো পৃথিবীর সমস্যা। এখানে সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
  • সন্ত্রাসবাদ: সন্ত্রাসবাদীরা কোনো দেশের সরকার নয়, তাই তাদের সঙ্গে traditional power dynamics কাজ করে না।

রিয়ালিজম যেখানে উজ্জ্বল

  • ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা: আমেরিকা, চীন, রাশিয়া—এই দেশগুলো যেভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, সেখানে রিয়ালিজম এখনো খুব প্রাসঙ্গিক।
  • আঞ্চলিক সংঘাত: মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন—এই সব জায়গায় ক্ষমতার লড়াই এখনো চলছে, আর রিয়ালিজম আমাদের সেই লড়াই বুঝতে সাহায্য করে।

বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ: বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

বাংলাদেশের জন্য রিয়ালিজম কেন জরুরি, সেটা একটু আলোচনা করা যাক।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা

বাংলাদেশকে সবসময় তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়। আমাদের চারপাশে অনেক শক্তিশালী দেশ আছে। তাই, আমাদের এমন নীতি নিতে হবে, যাতে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি।

অর্থনৈতিক স্বার্থ

আমাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা দরকার। তবে, সব সময় মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের স্বার্থ সবার আগে।

কূটনৈতিক চাল

কূটনীতির মাধ্যমে আমাদের এমন একটা অবস্থান তৈরি করতে হবে, যাতে আমরা আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের কথা বলতে পারি।

রিয়ালিজম নিয়ে কিছু জটিল প্রশ্ন (এবং সহজ উত্তর)

এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং সেগুলোর সহজ উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাকে রিয়ালিজম আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে:

প্রশ্ন উত্তর
রিয়েলিজম কি সবসময় যুদ্ধ সমর্থন করে? একদমই না। রিয়েলিজম শুধু বলে, দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য যা দরকার, তাই করে। অনেক সময় সেটা যুদ্ধ হতে পারে, আবার অনেক সময় শান্তি আলোচনাও হতে পারে।
রিয়েলিজম কি নৈতিকতা মানে না? রিয়েলিজম বলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নৈতিকতার চেয়ে স্বার্থটা বেশি জরুরি। তবে এর মানে এই নয় যে, রিয়েলিজম অনৈতিক। এটা শুধু বলে, দেশগুলো তাদের নিজেদের নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে ভালো যেটা, সেটাই করবে।
রিয়েলিজম কিভাবে কাজ করে? রিয়েলিজম ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ব্যাখ্যা করে। এটিতে রাষ্ট্রগুলিকে প্রধান অভিনেতা হিসাবে দেখা হয়, প্রত্যেকেই একটি অরাজক ব্যবস্থায় তাদের আপেক্ষিক ক্ষমতা সর্বাধিকীকরণের চেষ্টা করে। এই কাঠামোটি জোট গঠন, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

শেষ কথা: রিয়েলিজম, আপনি আর আমি

রিয়ালিজম হয়তো একটু কঠিন শোনাতে পারে, কিন্তু এটা আমাদের চারপাশের দুনিয়াকে বোঝার একটা জরুরি উপায়। আমরা যখন খবর দেখি, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করি, তখন রিয়েলিজমের ধারণাগুলো আমাদের কাজে লাগতে পারে।

তাহলে, আজ থেকেই রিয়ালিজমের চশমা চোখে লাগিয়ে দুনিয়াটাকে নতুন করে দেখুন। কে জানে, হয়তো আপনিও একদিন বড় কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হয়ে যেতে পারেন!

যদি এই লেখাটি আপনার ভালো লাগে, তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন। আর আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *