বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম: জেনেনিন আপনার অধিকার!

আহ, পরিবার! আমাদের জীবনে এর চেয়ে মধুর আর কী হতে পারে, বলুন তো? আর যখন পরিবারে বাবা-মা থাকেন, তখন তো মনে হয় যেন এক ছাদের নিচে সুখের স্বর্গ। কিন্তু জীবনের নিয়ম মেনেই একদিন আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাই। তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো সামনে আসে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাবার সম্পত্তি ভাগাভাগি। শুনেই হয়তো একটু অস্বস্তি লাগছে, তাই না? জানি, এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলাটা অনেকের কাছেই বেশ স্পর্শকাতর। কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি তো হতেই হবে।

আমাদের বাংলাদেশে, বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়মকানুনগুলো কিন্তু বেশ জটিল। শরিয়া আইন, পারিবারিক আইন, আর কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রথার কারণে এই বিষয়গুলো আরও গোলমেলে হয়ে ওঠে। আমরা অনেকেই ভাবি, "আরে বাবা, এটা তো আইনজীবীর কাজ!" কিন্তু নিজের অধিকার আর নিয়মকানুন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা থাকাটা কিন্তু খুবই জরুরি। এতে আপনি যেমন নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন, তেমনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি থেকেও বাঁচতে পারবেন। তাই আজ আমরা এই জটিল বিষয়টাকে সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করব। চলুন, তাহলে শুরু করা যাক!

Table of contents

বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম: কেন এটা জানা জরুরি?

আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, "বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম জেনে আমার কী লাভ?" খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন! দেখুন, আমাদের সমাজে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে অসংখ্য পারিবারিক কলহ তৈরি হয়। ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী মামলা-মোকদ্দমাও চলে। এর মূল কারণ হলো অজ্ঞতা। যখন আপনি নিয়মকানুন সম্পর্কে জানবেন, তখন আপনি যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তেমনি অন্যদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিও কমবে।

সম্পত্তির প্রকারভেদ: আগে জানুন, তারপর বুঝুন

বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম জানার আগে, সম্পত্তির প্রকারভেদ সম্পর্কে আমাদের একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। সাধারণত, সম্পত্তিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

  • স্থাবর সম্পত্তি: জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, বাগান ইত্যাদি যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায় না।
  • অস্থাবর সম্পত্তি: টাকা, স্বর্ণ, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, শেয়ার, আসবাবপত্র ইত্যাদি যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায়।

বাবার মৃত্যুর পর স্থাবর এবং অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তিই ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করা হয়।

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন: শরিয়ার আলোয় সম্পত্তি বন্টন

আমাদের বাংলাদেশে মুসলিমদের জন্য বাবার সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বা শরিয়া আইন অনুসরণ করা হয়। এই আইন বেশ সুনির্দিষ্ট এবং এর কিছু মৌলিক নীতি আছে।

ওয়ারিশ কারা?

বাবার মৃত্যুর পর, যারা তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হন, তাদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:

  • আসহাবুল ফুরুজ (নির্দিষ্ট অংশীদার): এরা হলেন সেইসব ওয়ারিশ, যাদের অংশ শরিয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। যেমন: স্বামী/স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী।
  • আছাবা (অবশিষ্টভোগী): আসহাবুল ফুরুজদের অংশ দেওয়ার পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে, তা এরা পান। যেমন: ছেলে, ছেলের ছেলে (নাতি), ভাই, চাচা।
  • যাবিল আরহাম (দূর সম্পর্কের আত্মীয়): যদি আসহাবুল ফুরুজ বা আছাবা কেউ না থাকেন, তখন এরা সম্পত্তি পান। তবে বাংলাদেশে সাধারণত এই শ্রেণির ওয়ারিশরা সম্পত্তি পান না, যদি না উপরের দুই শ্রেণির কেউ না থাকেন।

ছেলে ও মেয়ের অংশের অনুপাত

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে ছেলে ও মেয়ের সম্পত্তির অংশের অনুপাত সুনির্দিষ্ট। এটি হলো ২:১। অর্থাৎ, ছেলে যা পায়, মেয়ে তার অর্ধেক পায়। এর কারণ হলো, ইসলামে ছেলের ওপর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বেশি।

স্ত্রী ও অন্যান্য ওয়ারিশদের অংশ

বাবার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী (যদি থাকেন), বাবা, মা, এবং অন্যান্য ওয়ারিশরা তাদের নির্দিষ্ট অংশ পান।

  • স্ত্রী: যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে, তবে স্ত্রী মোট সম্পত্তির ১/৮ অংশ পান। আর যদি সন্তান না থাকে, তবে স্ত্রী ১/৪ অংশ পান।
  • বাবা ও মা: যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে, তবে বাবা ও মা প্রত্যেকে মোট সম্পত্তির ১/৬ অংশ করে পান। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে, তবে মা ১/৩ অংশ পান এবং বাবা অবশিষ্ট অংশ পান।

একটি সহজ উদাহরণ

Google Image

ধরুন, একজন ব্যক্তি মারা গেলেন। তার স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। তার মোট সম্পত্তি ১ কোটি টাকা।

  • স্ত্রী: ১/৮ অংশ = ১২,৫০,০০০ টাকা
  • অবশিষ্ট সম্পত্তি: ১,০০,০০,০০০ – ১২,৫০,০০০ = ৮৭,৫০,০০০ টাকা
  • ছেলে ও মেয়ের অনুপাত: ২:১। অর্থাৎ, ছেলে ২ ভাগ, মেয়ে ১ ভাগ। মোট ৩ ভাগ।
  • প্রতি ভাগের মূল্য: ৮৭,৫০,০০০ / ৩ = ২৯,১৬,৬৬৬.৬৭ টাকা (প্রায়)
  • ছেলে পাবে: ২ * ২৯,১৬,৬৬৬.৬৭ = ৫৮,৩৩,৩৩৩.৩৪ টাকা (প্রায়)
  • মেয়ে পাবে: ১ * ২৯,১৬,৬৬৬.৬৭ = ২৯,১৬,৬৬৬.৬৭ টাকা (প্রায়)

এই হিসাবটা আসলে বেশ জটিল হতে পারে, কারণ ওয়ারিশদের সংখ্যা এবং তাদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে অংশ পরিবর্তিত হয়। তাই একটি অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়াটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।

অমুসলিম উত্তরাধিকার আইন: ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন নিয়ম

বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তির বন্টন হয়। এই আইনগুলো মুসলিম উত্তরাধিকার আইন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

হিন্দুদের ক্ষেত্রে দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা এই দুটি প্রধান মতবাদ রয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত দায়ভাগ মতবাদ অনুসরণ করা হয়। দায়ভাগ মতে, পিতার মৃত্যুর পর পুত্ররা সম্পত্তির সমান অংশ পায়। কন্যাদের সম্পত্তির অধিকার সীমিত। তবে সম্প্রতি কিছু সংস্কারের ফলে কন্যাদের অধিকার কিছুটা বেড়েছে।

খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইন

খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে The Indian Succession Act, 1925 (বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত) অনুযায়ী সম্পত্তি বন্টন হয়। এই আইনে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই সমান অংশ পায়।

উইল বা ওসিয়ত: বাবার শেষ ইচ্ছা

Google Image

অনেক বাবা তার জীবদ্দশায় উইল বা ওসিয়ত করে যান। উইল হলো একটি আইনি দলিল, যেখানে একজন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি কীভাবে বন্টন হবে, তা উল্লেখ করে যান।

উইলের বৈধতা

  • মুসলিম আইনে, একজন ব্যক্তি তার মোট সম্পত্তির ১/৩ অংশের বেশি উইল করতে পারেন না, যদি না ওয়ারিশরা তাতে সম্মতি দেন।
  • অমুসলিম আইনে, উইলের নিয়মকানুন ভিন্ন হতে পারে।

উইল যদি বৈধ হয়, তবে সেই অনুযায়ীই সম্পত্তির কিছু অংশ বন্টন করা হয়। তবে উইলে যদি কোনো ওয়ারিশের অধিকার খর্ব করা হয়, তবে তা আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে।

হেবা বা দান: জীবদ্দশায় সম্পত্তির হস্তান্তর

অনেক বাবা তার জীবদ্দশায় তার কিছু সম্পত্তি তার সন্তান বা অন্য কাউকে দান করে যান, যাকে হেবা বলে। হেবার মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করলে, সেই সম্পত্তি আর মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

হেবার শর্তাবলী

  • হেবা তখনই বৈধ হবে, যখন সম্পত্তি হস্তান্তরকারী সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হবেন।
  • হেবা স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে হতে হবে।
  • যাকে হেবা করা হচ্ছে, তার দখলে সম্পত্তি হস্তান্তর হতে হবে।

হেবা বা দান করার সময় সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা তৈরি না হয়।

সম্পত্তি বন্টনে আইনি প্রক্রিয়া: কীভাবে শুরু করবেন?

Google Image

বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি বন্টনের জন্য কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি।

১. ওয়ারিশান সনদ সংগ্রহ

বাবার মৃত্যুর পর, প্রথমেই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি করপোরেশন থেকে ওয়ারিশান সনদ সংগ্রহ করতে হবে। এই সনদে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের নাম, ঠিকানা এবং তাদের সাথে মৃত ব্যক্তির সম্পর্ক উল্লেখ থাকে।

২. সম্পত্তির হিসাব ও মূল্যায়ন

মৃত ব্যক্তির সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে হবে। প্রতিটি সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

৩. বন্টননামা দলিল

ওয়ারিশরা যদি নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগিতে একমত হন, তবে একটি বন্টননামা দলিল তৈরি করা যেতে পারে। এটি একটি আইনি দলিল, যেখানে প্রতিটি ওয়ারিশের প্রাপ্ত অংশের বিস্তারিত বিবরণ থাকে। বন্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক, এতে ভবিষ্যতে কোনো বিরোধের সুযোগ থাকে না।

৪. আদালতের আশ্রয়

যদি ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টন নিয়ে মতবিরোধ হয়, তবে যে কোনো ওয়ারিশ আদালতে বন্টন মামলা (Partition Suit) দায়ের করতে পারেন। আদালত তখন আইন অনুযায়ী সম্পত্তির বন্টন করে দেবেন।

সাধারণ ভুল এবং সতর্কতা

বাবার সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ ভুল এবং সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি:

  • অজ্ঞতা: আইন সম্পর্কে না জানাটা সবচেয়ে বড় ভুল।
  • ইচ্ছাকৃত বন্টনে ত্রুটি: অনেক সময় কিছু ওয়ারিশ অন্য ওয়ারিশদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করে, যা পরবর্তীতে বড় সমস্যা তৈরি করে।
  • দলিলের অভাব: মৌখিক চুক্তি বা দলিল ছাড়া সম্পত্তি বন্টন করা উচিত নয়।
  • কর ফাঁকি: সম্পত্তির সঠিক মূল্য গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলে আইনি জটিলতা বাড়ে।
  • আবেগপ্রবণতা: সম্পত্তি বন্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আবেগপ্রবণ না হয়ে বাস্তববাদী হওয়া উচিত।

একটি প্রয়োজনীয় পরামর্শ

বাবার সম্পত্তি ভাগের বিষয়টি যেহেতু খুবই সংবেদনশীল এবং আইনি জটিলতা থাকতে পারে, তাই একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। একজন ভালো আইনজীবী আপনাকে সঠিক পথে নির্দেশনা দিতে পারবেন এবং আইনি প্রক্রিয়া সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবেন।

শেষ কথা: শান্তির জন্য সুরাহা

সম্পত্তি মানেই শুধু জমি-জমা বা টাকা-পয়সা নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকে মানুষের আবেগ, শ্রম আর স্মৃতি। বাবার সম্পত্তি ভাগ করাটা তাই কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি পারিবারিক শান্তি ও সম্প্রীতিরও একটি বড় অংশ। যখন আপনি নিয়মকানুন মেনে চলবেন, তখন যেমন নিজের অধিকার রক্ষা করতে পারবেন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেও পারবেন।

মনে রাখবেন, আইনের সঠিক প্রয়োগই পারে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। তাই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে রাখাটা আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই আলোচনা আপনার মনে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে। আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে প্রশ্ন করতে পারেন। আমরা চেষ্টা করব আপনার কৌতুহল মেটাতে। কারণ, আপনার জানাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *