আপনি কি কখনও ভেবেছেন, কোনো বড় অংকের টাকা নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে চান, কিন্তু ক্যাশ নিয়ে চলাফেরা করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে? অথবা এমন কোনো লেনদেন যেখানে চেক বা ক্যাশের বদলে আরও নির্ভরযোগ্য কিছু প্রয়োজন? ঠিক তখনই ব্যাংক ড্রাফট আপনার সেরা বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। ব্যাংক ড্রাফট (Bank Draft) হচ্ছে এমন একটি আর্থিক দলিল যা আপনাকে নিশ্চিন্তে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করার সুযোগ দেয়। এটি অনেকটা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি গ্যারান্টি, যেখানে ব্যাংক নিজেই প্রাপককে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়।
বাংলাদেশে ব্যাংক ড্রাফট একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য লেনদেন পদ্ধতি, বিশেষ করে যখন ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি, সরকারি আবেদন ফি, বা কোনো বড় কেনাকাটার জন্য টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে, 'ব্যাংক ড্রাফট করার নিয়ম' আসলে কতটা সহজ! চলুন, আজ আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সেবাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব এবং দেখব কীভাবে আপনি আপনার প্রয়োজনে খুব সহজে একটি ব্যাংক ড্রাফট তৈরি করতে পারেন।
ব্যাংক ড্রাফট কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
ব্যাংক ড্রাফট (Bank Draft) হলো একটি প্রিপেইড আর্থিক দলিল, যা একটি ব্যাংক তার গ্রাহকের অনুরোধে ইস্যু করে। এর মানে হলো, ড্রাফট ইস্যু করার আগেই গ্রাহককে টাকাটা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এরপর ব্যাংক সেই টাকার সমপরিমাণ একটি ড্রাফট তৈরি করে দেয়, যা নির্দিষ্ট প্রাপককে দেওয়া হয়। প্রাপক সেই ড্রাফট দেখিয়ে তার ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন।
এর গুরুত্বের কয়েকটি কারণ:
- নিরাপত্তা: এটি ক্যাশ টাকার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। ড্রাফট হারিয়ে গেলেও এর অপব্যবহারের সুযোগ কম, কারণ এটি ক্রসড থাকে এবং নির্দিষ্ট প্রাপকের নাম উল্লেখ থাকে।
- নির্ভরযোগ্যতা: ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্যারান্টি থাকায়, ড্রাফট বাউন্স হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না, যেমনটা ব্যক্তিগত চেকের ক্ষেত্রে হতে পারে।
- বড় অঙ্কের লেনদেন: বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের জন্য এটি একটি আদর্শ মাধ্যম।
- অফিসিয়াল লেনদেন: সরকারি বা বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের জন্য ব্যাংক ড্রাফট বাধ্যতামূলক।
ব্যাংক ড্রাফট করার নিয়ম: ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া
ব্যাংক ড্রাফট করাটা আসলে খুব সহজ একটা প্রক্রিয়া। চলুন, ধাপে ধাপে জেনে নেই কীভাবে আপনি একটি ব্যাংক ড্রাফট তৈরি করবেন।
ধাপ ১: প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি
ব্যাংকে যাওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি দরকার। এতে আপনার সময় বাঁচবে এবং কাজটি সহজে হয়ে যাবে।
- প্রাপকের সঠিক তথ্য সংগ্রহ: যার নামে ড্রাফট করবেন, তার সঠিক নাম (প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নাম) এবং ঠিকানা জেনে নিন। নামের বানানে ভুল হলে ড্রাফট বাতিল হতে পারে।
- পরিমাণ নির্ধারণ: কত টাকার ড্রাফট করবেন, সেই পরিমাণটা নিশ্চিত করুন।
- খরচ সম্পর্কে ধারণা: ড্রাফট করার জন্য ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট ফি বা কমিশন কেটে নেয়। এটি সাধারণত ড্রাফটের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। কিছু ব্যাংক নির্দিষ্ট অঙ্কের জন্য নির্দিষ্ট ফি নেয়। ব্যাংকে যাওয়ার আগে ফি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন।
ধাপ ২: ব্যাংকে যাওয়া এবং ফর্ম সংগ্রহ
আপনার পছন্দের বা যে ব্যাংকে আপনার অ্যাকাউন্ট আছে, সেই ব্যাংকের শাখায় যান।
- ফর্ম সংগ্রহ: ব্যাংক ড্রাফট (Bank Draft) বা ডিমান্ড ড্রাফট (Demand Draft – DD) ফরম সংগ্রহ করুন। কিছু ব্যাংকে এটি 'Pay Order' ফরম নামেও থাকতে পারে।
ধাপ ৩: ফরম পূরণ
এই অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরমটি খুব সতর্কতার সাথে পূরণ করতে হবে।
- তারিখ: যে তারিখে ড্রাফট করছেন, সেই তারিখ লিখুন।
- প্রাপকের নাম: যার নামে ড্রাফট করছেন, তার সঠিক নাম লিখুন। এটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে পারে।
- টাকার পরিমাণ (অংকে ও কথায়): কত টাকার ড্রাফট করছেন, সেই পরিমাণটি অংকে এবং কথায় উভয়ভাবে লিখুন। যেমন, "১,০০,০০০/- (এক লক্ষ টাকা মাত্র)"।
- আপনার নাম ও ঠিকানা: আপনার সম্পূর্ণ নাম, ঠিকানা, এবং ফোন নম্বর লিখুন।
- হিসাব নম্বর (যদি থাকে): যদি আপনার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে, তবে আপনার হিসাব নম্বর উল্লেখ করুন। যদি না থাকে, তবে আপনার পরিচয়পত্র (যেমন: এনআইডি কার্ড) নিয়ে যেতে হবে।
- উদ্দেশ্য (ঐচ্ছিক): কিছু ফরমে ড্রাফটের উদ্দেশ্য লেখার জায়গা থাকে, যেমন: "ভর্তি ফি", "পরীক্ষার ফি" ইত্যাদি। এটি ঐচ্ছিক, তবে লিখলে পরবর্তীতে সনাক্ত করতে সুবিধা হয়।
ফরম পূরণের উদাহরণ (কাল্পনিক):
তথ্য | বিবরণ |
---|---|
তারিখ | ০৮/১০/২০২৪ |
প্রাপকের নাম | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
টাকার পরিমাণ | ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র) |
আপনার নাম | মোঃ আরিফ হোসেন |
ঠিকানা | বাড়ি # ২৫, রোড # ০৩, ধানমন্ডি, ঢাকা |
ফোন নম্বর | ০১৭০০-১২৩৪৫৬ |
হিসাব নম্বর | (যদি থাকে) |
উদ্দেশ্য | বি.এ. ভর্তি ফি |
ধাপ ৪: ফি এবং টাকা জমা দেওয়া
ফরম পূরণ হয়ে গেলে, ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে ফরমটি জমা দিন।
- টাকা জমা: আপনি যদি নগদ টাকা দিয়ে ড্রাফট করেন, তবে সেই টাকা এবং ড্রাফটের ফি ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিন।
- অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট: যদি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকে এবং আপনি সেখান থেকে ড্রাফট করতে চান, তবে ব্যাংক আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা এবং ফি কেটে নেবে।
ধাপ ৫: ড্রাফট সংগ্রহ
টাকা জমা দেওয়ার পর, ব্যাংক কর্মকর্তা আপনার ফরম এবং জমার রশিদ যাচাই করে আপনাকে একটি ব্যাংক ড্রাফট ইস্যু করবেন।
- যাচাই করুন: ড্রাফট হাতে পাওয়ার পর, এর উপর লেখা প্রাপকের নাম, টাকার পরিমাণ এবং তারিখ ঠিক আছে কিনা, তা ভালো করে দেখে নিন। কোনো ভুল থাকলে তাৎক্ষণিক ব্যাংক কর্মকর্তাকে জানান।
ব্যাংক ড্রাফট করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
- সঠিক বানান: প্রাপকের নামের বানান এবং টাকার পরিমাণ নির্ভুলভাবে লিখুন। সামান্য ভুলও ড্রাফট বাতিল করতে পারে।
- পরিচয়পত্র: যদি আপনার ওই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকে, তাহলে ব্যাংক ড্রাফট করার জন্য আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা পাসপোর্ট সঙ্গে রাখুন। কিছু ব্যাংক গ্রাহক ছাড়া ড্রাফট ইস্যু করে না।
- রসিদ সংরক্ষণ: ব্যাংক ড্রাফট করার পর যে রসিদটি পাবেন, সেটি যত্ন করে রাখুন। এটি আপনার লেনদেনের প্রমাণ।
- ড্রাফট ক্রসড রাখা: বেশিরভাগ ব্যাংক ড্রাফট সাধারণত "A/C Payee Only" বা "Not Negotiable" হিসেবে ক্রসড থাকে, যার অর্থ হলো এটি শুধুমাত্র প্রাপকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে, নগদ টাকা তোলা যাবে না। এটি নিরাপত্তার জন্য খুবই ভালো।
- মেয়াদ: ব্যাংক ড্রাফটের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে, সাধারণত ৩ মাস। এই মেয়াদের মধ্যে প্রাপককে ড্রাফটটি ভাঙাতে হবে।
ব্যাংক ড্রাফট বনাম পে-অর্ডার: পার্থক্য কী?
অনেকেই ব্যাংক ড্রাফট এবং পে-অর্ডারকে (Pay Order) এক মনে করেন। যদিও দুটিই ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের নিরাপদ মাধ্যম, তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে:
বৈশিষ্ট্য | ব্যাংক ড্রাফট (Bank Draft) | পে-অর্ডার (Pay Order) |
---|---|---|
ব্যবহার | সাধারণত দূরবর্তী স্থানে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে প্রাপক অন্য কোনো ব্যাংকের শাখা থেকে টাকা তোলেন। | একই শহরের মধ্যে লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে প্রাপক সাধারণত একই ব্যাংকের বা অন্য কোনো স্থানীয় ব্যাংকের শাখা থেকে টাকা তোলেন। |
ইস্যুকারী | ইস্যুকারী ব্যাংক তার নিজস্ব শাখা বা অন্য কোনো ব্যাংকের শাখাকে টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়। | ইস্যুকারী ব্যাংক তার নিজস্ব শাখাকে বা অন্য কোনো স্থানীয় ব্যাংকের শাখাকে টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়। |
বৈধতা | আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য বেশি উপযোগী। | স্থানীয় লেনদেনের জন্য বেশি উপযোগী। |
প্রাপক | সাধারণত নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। | নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। |
মূল্য | সাধারণত বড় অঙ্কের লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। | তুলনামূলক ছোট বা মাঝারি অঙ্কের লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। |
সহজ কথায়, ব্যাংক ড্রাফট হলো দূরপাল্লার ট্রেনের মতো, যা এক শহর থেকে অন্য শহরে যায়। আর পে-অর্ডার হলো লোকাল বাসের মতো, যা একই শহরের মধ্যে চলাচল করে।
ব্যাংক ড্রাফটের খরচ কেমন?
ব্যাংক ড্রাফট করার খরচ ব্যাংকভেদে ভিন্ন হয়। সাধারণত, এটি ড্রাফটের পরিমাণের উপর একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে নেওয়া হয়, অথবা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের জন্য একটি ফ্ল্যাট ফি নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ব্যাংক প্রতি ১,০০০ টাকার জন্য ৫ টাকা চার্জ করতে পারে, আবার কিছু ব্যাংক ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ড্রাফটের জন্য ৫০ টাকা ফি নিতে পারে। বড় অঙ্কের ড্রাফটের ক্ষেত্রে ফি কিছুটা বেশি হতে পারে। ব্যাংকে যাওয়ার আগে আপনার নির্দিষ্ট ব্যাংকের চার্জ জেনে নেওয়া ভালো।
উপসংহার
আশা করি, 'ব্যাংক ড্রাফট করার নিয়ম' সম্পর্কে আপনার আর কোনো প্রশ্ন নেই। ব্যাংক ড্রাফট হলো আপনার আর্থিক লেনদেনকে আরও নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য করার একটি চমৎকার উপায়। এটি আপনাকে মানসিক শান্তি দেবে, যখন আপনি জানবেন যে আপনার টাকা নিরাপদে এবং সঠিক হাতে পৌঁছে যাবে। পরের বার যখন আপনার কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন করতে হবে, তখন ব্যাংক ড্রাফটকে আপনার প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করুন।
আপনার কি কখনও ব্যাংক ড্রাফট করার প্রয়োজন হয়েছে? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? অথবা ব্যাংক ড্রাফট নিয়ে আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে কি? নিচে মন্তব্য করে আমাদের জানান। আপনার মতামত এবং প্রশ্ন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ!